মারুফ হোসেন মিলন, শ্যামনগরঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় এলাকা দুর্যোগ প্রবন এলাকা হিসাবে পরিচিত। প্রতিনিয়ত নানান ধরনের দুর্যোগ যেন লেগে আছে এখানে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, ক্ষরা ও লবনাক্তার প্রাদুর্ভাবে উকুলীয় কৃষি বিপদাপন্ন। আর এ বিপদাপন্নতার মধ্যে দিয়ে নানা ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হচ্ছে কৃষকদের। কখনো লবন পানির চিংড়ি ঘেরের পাশে ধান লাগিয়ে, কখনো জলাবদ্ধ জায়গায় ধান লাগিয়ে, কখনো ক্ষরা জায়গায় ব্যক্তি পর্যায়ে, সমন্বিত ভাবে বা সংগঠিত হয়ে আমন ও আউশ মৌসুমের ফসল লাগানোর চেষ্টা করছে। ধানের পাশাপশি শিম, ডাটাশাক, মরিচ, আদা, বেগুন ও স্থানীয় প্রানী সম্পদ (মুরগি) নিয়ে পরীক্ষামুলক গবেষণার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর তাদের এ কাজকে বারসিক ২০০১ সাল থেকে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্টীর মাঝে অংশগ্রহন করে তাদের পাশে থেকে তাদের কর্মউদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করার পাশাপশি ঐক্য ও সমন্বয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে কৃষকদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে একটি কৃষক গবেষক দলের আত্নপ্রকাশ হয় । মুলত এলাকা উপযোগী ফসলের জাত নির্বাচন, কৃষকের সমস্যা সমাধানে পারস্পারিক জ্ঞান-দক্ষতা বিনমিয়, এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে সমন্বিত ভাবে উদ্যোগ গ্রহন করা,গবেষণার ফলাফল কৃষক থেকে কৃষক, একজনগোষ্ঠী থেকে অন্য জনগোষ্ঠীর, একগ্রাম থেকে আরেক গ্রাম এভাবে সম্প্রসারণ করা।
তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার (৩০ অক্টোবর) সকাল ১০টায় শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিযনের টেংরাখালী গ্রামের টেংরাখালী কৃষিপ্রতিবেশ শিখন কেন্দ্রের আযোজনে ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্টান বারসিক’র সহায়তায় কৃষক গবেষক দলের মতবিনিময় সভা অনুষ্টিত হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় কৃষক হাবিবুর রহমানের সভাপত্তিত্বে ও বারসিক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ মন্ডলের সঞ্চালনায় এবং রামকৃষ্ণ জোয়ারাদরের শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে সভার সুচনা হয়। এসময় আরোও উপস্থিত ছিলেন বারসিকের প্রোগ্রাম অফিসার বাবলু জোয়ারদার, মারুফ হোসেন মিলন, আবুল কালাম প্রতিমা চ্যাটার্জী সহ ১২ টি ইউনিয়নের কৃষক নেতৃবৃন্দ। এরপর স্ব স্ব এলাকার কৃষকরা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন আমরা আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য একটা প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলাম সেটি আরো মজবুত করতে হবে।কমিটি পুনঃগঠন করতে হবে। সকলে মিলে এলাকার জন্য ভালো কিছু করতে হবে।
কৃষক দেবীরঞ্জন বলেন, বর্তমানে আমন মৌসুম চলছে এই সময়ে কোন জাতগুলো আমাদের এলাকা উপযোগী তা নির্বাচন করতে হবে। একই সাথে কোন মৌসুমে আমাদের এলাকায় কি ওেজকি ফসল চাষ হয় সেখানে প্রধান সমস্যা কি তা বের করতে হবে। এলাকায় ধান ফসলের সাথে সাথে সবজী, মসলা, ডাল ও প্রানী সম্পদ নিয়ে কি করা যাবে সেটিও ভাবতে হবে।
কৃষক গংগারাম বলেন, আমার বাড়িতে যে ২২ ধরনের শিম আছে সেটি আমি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাই। যাতে এ জাত গুলো সম্প্রসারণ হয়। সাথে ইউনিয়ন ভিত্তিক কিছু প্রদর্শনী প্লট রাখা যা দেখে কৃষক উৎসাহিত হতে পারে।
কৃষানী সরমা রানী বলেন যে, আমরা পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে চলার চেষ্টা করছি। একসময় এলাকাতে অচাষকৃত অনেক ধরনের শাক পাওযা যেত সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য বাড়িতে সংরক্ষণে রাখছি। সাথে আমরা বিভিন্ন ধরনের মসলার চাষ বাড়াচ্ছি।
বনজীবী নারী শেফালী বিবি জানান যে, আমাদের সকল পেশার মানুষ নিয়ে এই কমিটি তৈরি। এখানে যেমন কৃষকের সমস্যা তেমিনি আমাদের বনজীবীদের সমস্যা আছে প্রত্যোকে আমরা প্রত্যোকের পাশে থেকে সহায়তা করবো। আমি যেমন বলতে পারবো যে বনায়নের জন্য লবন সহনশীল কোন গাছ এবং কোন সময়ে লাগালে ভালো হবে। তেমনি কৃষক তার জায়গা থেকে বলতে পারবে কোন সময় কোন ফসল ফলাতে হবে। আমরা বনজীবী সংগঠন একটি নার্সারী করতে চাই নদীর চরে যেখান থেকে লবন সহনশীল বনজগাছ বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রসারন করা যাবে।
সবশেষে কৃষক গবেষক দল আগামীতে কি ধরনের কার্যক্রম করতে পাবে তার একটি পরিকল্পনা প্রননয়ন করেন। তাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিলো এলাকা উপযোগী ধান- সবজি, মসলা , ডাল, ফলজ ফসল নির্বাচন করা, পরিক্ষণীয় ভাবে পাট চাষ করা, গম চাষ করা, খেসারী,চৈতী মুগ ডাল চাষ, সরিষা চাষ, শিম সম্প্রসারন, কৃষি পাঠশালা গুলোতে নার্সারী তৈরি, আগামীতে আরো বেশি হারে স্থানীয় ধান চাষ বাড়ানো, বিষমুক্ত সবজী উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি, দেশি প্রানী সম্পদ পালন ও বৃদ্ধি করা, জৈব সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি।
উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ টিকিয়ে রেখে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে উপকুলীয় অঞ্চলের জন্য সম্মিলিতভাবে ফসল পঞ্জিকা তৈরির মাধ্যমে মতবিনিময় সভার সমাপ্তি হয়।